হুমকির মুখে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ
॥ অধ্যাপক মোঃ হারুন অর রশীদ ॥
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে ভরপুর রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় অবস্থিত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদ। ১৯৬০ সালে চালু হওয়া কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প নামের এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন মূখ্য উদ্দেশ্য হলেও অন্যান্য আরো কয়েকটি লক্ষ্য ছিলো। এসব উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিলো মৎস্য উৎপাদন, সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, নৌ পথে যাতায়াত ও পরিবহণ প্রভৃতির মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।
কাপ্তাই হ্রদ দেশে স্বাদু পানির মাছের অন্যতম উৎস। এ হ্রদের আয়তন ৬৮৮০০ হেক্টও (৭০০বর্গমাইল)। এক সময় দেশীয় মৎস্য ভান্ডারের এক উল্লেখযোগ্য উৎস্য ছিলো হ্রদটি। বর্তমানে নানা কারণে হ্রদে মৎস্য উৎপাদনের পরিমান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গভেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে হ্রদ সৃষ্টির প্রথম দিকে ৭৫ প্রজাতির মাছ চিহ্নিত করা হয় এখানে। এর মধ্যে ৬৭ প্রজাতির মাছ ছিলো দেশীয় এবং বাকী ৮ প্রজাতির মাছ ছিলো বিদেশী। এসব প্রজাতির মধ্যে সীলন, দেশী সরপুটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মোহিনী বাটা, দেশি পাঙ্গাস, মহাশোল, পাবদা, পোয়াম ফাইস্যা, সাদা ঘনিয়া প্রভৃতি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্তির পথে রয়েছে। ১৯৬৫-৬৬ সালে রুই, কাতল, মৃগাল, কালি বাউস, মহাশোলসহ সামগ্রিকভাবে মেজর কার্প ছিল মোট মৎস্য আহরণের ৮১.৩৫% যা বর্তমানে ৩% এর নিচে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ছোট মাছ বিশেষ করে চাপিলা, মলা, কাচকি প্রভৃতি ছোট মাছের পরিমান ১৯৬৫-৬৬ সালে রেকর্ডকৃত ৩% থেকে বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৯০% এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। কাপ্তাই হ্রদে ক্রমাগত মৎস্য সম্পদ হ্রাস পাওয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ চিহ্নিত করা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধিও অভিঘাত হ্রদের পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর একটি সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হ্রদে পর্যটকদের অবাদ বিচরণ এবং বর্জ্য নিক্ষেপের কারণেও হ্রদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্থনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যাওয়ায় হ্রদের পানির উচ্চতা প্রায়ই কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নিত হয় না। হ্রদের সাথে সংযুক্ত নদীগুলো যেমন কাচালং, মাইনী, কর্ণফুলী, চেংগী প্রভৃতির নব্যতা হ্রাস ক্রমাগত পলি জমা হয়ে হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় রুই জাতীয় মাছের প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক প্রজনন স্থল (কাচালং চ্যানেল, মাইনীমুখ, বরকল চ্যানেল, জগন্নাথছড়ি, চেংগী চ্যানেল, নানিয়ারচর, রাইংক্ষনং চ্যানেল) নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারেন্ট জালসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জালের ব্যাপক ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে অবাধে পোনা মাছ ও মা মাছ ধরা, শুষ্ক মৌসুমে অধিক মাছ আহরণ, হ্রদের তীর ঘেষে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে হ্রদে মৎস্য সম্পদই শুধু হ্রাস পাচ্ছেনা, জীব বৈচিত্রও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া হ্রদে মৎস্য সম্পদ তদারককারী কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাতো আছেই।
কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য সম্পদ তদারকীর দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন। কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সংস্থাটি এ যাবৎ উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি। প্রত্যেক বছর মে মাস থেকে পরবর্তী তিন বা সাড়ে তিনমাস হ্রদে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের জন্য মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু দেখা যায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন রাঙামাটি থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে মাছ রপ্তানি বন্ধ থাকলেও স্থানীয় বাজারগুলোতে ডিমওয়ালা মাছসহ অন্যান্য মাছ অবাধে বিক্রি হয়। তাছাড়া নয় ইঞ্চির চেয়ে ছোট আকারের কার্প জাতীয় মাছ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও স্থানীয় বাজারগুলোতে এর চেয়ে ছোট আকারের কার্প জাতীয় মাছ অবাধে বিক্রি হয়। বিএফডিসির তথ্য মতে কাপ্তাই হ্রদে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২১,৬২১ (একুশ হাজার ছয়শত একুশ) জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতসংখ্যক জেলে এই জলাশয়ে মাছ শিকার করে তার হিসাব নেই। মাছ ধরার জন্য এই হ্রদ অনেকটা সকলের জন্য উন্মুক্ত। সুতরাং বিএফডিসিকে কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে আরো সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের একটি অন্যন্য সম্পদ। এ হ্রদে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে নিন্মোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত : কাপ্তাই হ্রদের সাথে সংযুক্ত নদীগুলো এবং কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ড্রেজিং করে পলি অপসারন পূর্বক নাব্যতা সৃষ্টি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত ঃ প্রাকৃতিক প্রজননের মৌসুমে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকা অবস্থায় যাতে কেউ মাছ ধরতে এবং বিক্রি করতে না পারে সে ব্যাপারে আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৃতীয়ত ঃ মাছের অভয়াশ্রম ঘোষিত এলাকাগুলোতে যাতে কোন প্রকারের মাছ ধরতে না পারে সে দিকে সারা বছর তদারকি করতে হবে।
চতুর্থত ঃ প্রতিবছর হ্রদে অবমুক্তকৃত পোনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পোনা অবমুক্ত করেই কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব শেষ করেন।
পঞ্চমত ঃ জেলেদের মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করতে হবে। জেলেদের দায়িত্বহীন কর্মকান্ড ও কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
এক সময় কাপ্তাই হ্রদে ১৫-২০ কেজি বা তারও বেশি ওজনের রুই, কাতল, বোয়াল চিতল প্রকৃতির মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে কালেভদ্রে এ ধরনের মাছ পাওয়া যায়। রাঙামাটির বাজারগুলোতে হ্রদের মাছ ছাড়া বিশেষ বিশেষ সময়ে কিছ’ সামুদ্রিক মাছ বিক্রি হলেও অন্য কোন উৎসের মাছ বিক্রি হতনা। অথচ বর্তমানে স্থানীয় বাজারের ৮০% ভাগের বেশি মাছ বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন প্রজেক্ট বা অন্যান্য উৎস্য থেকে সংগ্রহ করে। যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য সম্পদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতেই থাকবে। এ অবস্থা কারো কাম্য হতে পারে না।
লেখক : প্রভাষক, রাঙামাটি সিনিয়র মাদ্রাসা।